মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের ৩৬তম প্রযোজনা কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাপুড়ে’ গল্প আশ্রয়ে ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি দেখলাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। নাটকটি রচনা করেছেন আনন জামান। নির্দেশনায় ছিলেন ইউসুফ হাসান অর্ক। ঘুম অথবা জাগরণের ভেতর-ভুবন থেকে মনসা বলেছিল জহরকে, সে যদি একশ সাপের দংশন শরীরে নেয় আর কাম যদি নিজের শরীরে বন্ধক রাখতে পারে তবে জহর বিষ বশ করতে পারবে। একটি সাপের বিষ বুকে সয়ে জহর হত হয় কাম আর প্রেমের দংশনে।
রচয়িতা আনন জামান এই ‘নীলাখ্যান’ নাটকটির নাম দিয়েছেন, ‘জহরের পরান আর চৈতন্যের গোপন পাত্রের রাত আর আরতির নাট্য’। এই রাত আর আরতির নাট্যে নাট্য নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক সুনিপুণ হাতে নাটকটি নির্মাণ করেছেন। এই নাট্যে অভিনেতা নিজেই চরিত্র ও পরিস্থিতির বিবরণ উপস্থাপন করেন মঞ্চক্রিয়া সহযোগে। এ নাট্যে ইউরোপীয় চরিত্রাভিনয়কে সচেতনভাবে এড়িয়ে ‘ঋণাত্মক চরিত্রাভিনয়’ প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ঋণাত্মক অভিনয়রীতি কোনো এক আবিষ্কার নয়। আমাদের দেশজ পালাকার গায়েন-বয়াতিরা এভাবেই অভিনয় করেন। তাতে কাহিনির রসাস্বাদনে দর্শকের কোনো অসুবিধা হয় না। বরং দর্শকের চিত্তে নানা চিত্র চিত্রিত হতে থাকে। আমাদের ঐতিহ্যের ধারায় গায়েন, পালাকার, বয়াতিরা একাই কাহিনি বর্ণনা করতেন। কিন্তু এ নাট্য অথবা বর্ণনাত্মক চরিত্রাভিনয়ে সকলে মিলে একটি গল্প তুলে ধরেন। আমাদের ঐতিহ্যের গায়েনরা একাই অভিনয় করে মূল গল্পটি টেনে নিয়ে যান। সেখানে ‘নীলাখ্যান’ নাট্যে সকলে মিলে একটি কাহিনি বা আখ্যান বর্ণনা করেন। অতএব দেখা যাচ্ছে ইউসুফ হাসান অর্কের হাতে ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি পূর্ণতার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। তা এদেশ কালের উপর দাঁড়িয়ে। পার্থক্য এটুকু যে গায়েন, পালাকার, বয়াতিরা একা কাহিনি বলেন দেশজ রীতি, আর এ নাট্যে সকলে মিলে কাহিনিটা বলে। এ নাট্যে কোনো ইমেজকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং দর্শকের চিত্তের উপর ভর করে শ্রুতিময়তা ও দৃশ্যময়তা তৈরি হতে থাকে। তাই এটিকে বর্ণনাত্মক বা আখ্যান এমন একটি শিল্প আঙ্গিক যেখানে শ্রুতিময়তা দিয়ে দৃশ্যময়তা তৈরি হয়। ‘নীলাখ্যান’ প্রযোজনাটি ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে অভিনয়ের বর্ণনা। পোশাক, আলো, সঙ্গীতে মাখামাখি করতে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অথবা এগিয়ে দেয় প্রেমের টানে। সেখানে বিষ বল অথবা কাম সাধনে এক সময় জহরকে কাম অথবা প্রেমের টানে নীল হতে হয়। জহরের এ প্রেম দংশন। বেদিয়ার সর্দার জহরের বিষ জয় সাধনায় মনসা কর্তৃক কাম নিষিদ্ধ হলো। বেদিয়া বহরে বেড়ে ওঠা বালিকা চন্দনের চুলের সুরভি পায় জহর। নারী নিষিদ্ধ বলে এ বালিকা বেড়ে উঠেছিল বালকের বেশে। ঋতুমতী হয়ে ওঠার পর তার প্রতি প্রবল রাগ অনুভব করে জহর। বেদিয়া দলে তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় বিচিত্রমুখী সংকট। চন্দনের যুবা সাজে তাকে প্রেম নিবেদন করে মৌটুসী আর চন্দন ঠোঁটে মালতী ফুলের লাল ডালে ঝুমড়ির সামনে দাঁড়ায়। বেদিয়াদের উত্সবে চন্দনের নারীত্ব উন্মোচিত হয়। জহর চন্দনের প্রতি রতি আসক্ত হয়। যাকে পিতা মানে পাত্র হিসেবে তাকে মেনে নিতে পারে না চন্দন। ঝুমরোর সাথে পালায় চন্দন। ঝুমরোর জন্য জহরের ঝাঁপিতে আছে দাঁত না ভাঙা পোষা সাপ। জহর-মন্ময় নীলের দোলাচলে সে চিতল ফণায় টোকা দিয়ে সবাইকে ক্রোধমত্ত করে তোলে। এভাবেই নাট্য কাহিনি এগিয়ে যায়।