দেশীয় চলচ্চিত্রকে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা এবং চলচ্চিত্রকে ব্যবসা-সাফল্যে পরিণত করার একজন অকুতোভয় সৈনিক অভিনেতা ছিলেন আমার বাবা খলিল উল্যাহ খান। গতকাল ছিল তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তার প্রয়াণে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রতিভাবান একজন অভিনেতাকে। তাঁর প্রয়াণে তাঁর চরিত্রগুলোর ভাবান্তরে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার এই নিবেদন। লিখেছেন মুসা খান
সবার প্রিয় অভিনেতা খলিল আমার বাবা, যিনি টানা পাঁচ দশক অভিনয় করেছেন। তাঁর সময়কার একজন দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও জেলা আনসার অ্যাডজুট্যান্ট ছিলেন তিনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবার কিছু স্মৃতি তো আমার মনের ভিতরে গেঁথে আছে। বাবা অনেক গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন—যারা তাঁকে জানতেন, তারা তা স্বীকার করবেন। আমাদের ৯ ভাইবোনের মধ্যে আমি মেজো মানে দ্বিতীয়। বাবা আমাদের সব ভাইবোনকে তাঁর কাজকর্ম ও আচরণের মধ্যে দিয়ে অনেক কিছু শেখাতেন, অবিরাম শেখানোর চেষ্টা চালাতেন। বাবা খুবই কর্মঠ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যারাই মিশেছেন, তারা তা ভালোভাবেই জানেন। ১৯৭৮ সালে সরকারি চাকরিটি ফেরত (জেলা আনসার অ্যাডজুট্যান্ট পদ) পাওয়ার পরে আমার সেই বয়সে (তখন আমি কিশোর) তাঁর চেহারায় যে আনন্দের রূপ প্রত্যক্ষ করেছি, তা ছিল এক অসাধারণ সৌন্দর্যের, তাঁর হাসিটা ছিল হূদয়-ভোলানো। তিনি সেই ঘটনার পুরো বর্ণনা আমাদেরকে কখনো দেওয়ার সুযোগ পাননি, এখনো বেঁচে থাকলে হয়তো সেসব কথা তিনি আমাদেরকে বলতে পারতেন। আমার মনে আছে, সেই দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিন ভোরে উঠে বাবা সরকারি অফিসের কর্মস্থলে গিয়ে কাজ শুরু করে দিতেন, অফিস থেকে ফিরে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি টেলিভিশন ও সিনেমার শুটিংয়ে চলে যেতেন। বাসায় ফিরতে তাঁর গভীর রাত হয়ে যেত, এমনকি সারা রাত শুটিংয়ে অংশ নিয়ে ভোরবেলা ফিরে আসতেন। তারপর আবার অফিস...
বাবার জীবনের শেষ-প্রান্তের ৪/৫টি বছর আমি তাঁর কাছাকাছি কাটিয়েছি। কেন যেন তাঁর স্বভাবগত গম্ভীরতা কমিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর অতীত জীবনের নানা গল্প নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন। বলা যায়, তাতে বাবা কিছুটা স্বস্তি পেতেন। ২০১৪ সালের ১০ মে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০১২ সালের পুরস্কার) বিতরণ অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাবাকে একজন খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী হিসেবে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার আজীবন চিকিত্সার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই অনুষ্ঠানে বাবার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিলাম। সেই অনুষ্ঠানেই ওইসব ঘোষণা আসার পরেই শারীরিকভাবে দুর্বল বাবা উত্ফুল্ল হয়ে আমাদেরকে বললেন, ‘দেখলি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার চিকিত্সার সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। আমি এখন মনে জোর পাচ্ছি, মনটাও বেশ ভালো হয়ে গেল, আমি প্রাণভরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য, তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য দোয়া করছি, তোরাও তাঁর জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য দোয়া করবি।’
এত বড় আনন্দের ঘটনায় আমরা সবাই উদ্বেলিত, বঙ্গবন্ধু সম্মলন-কক্ষ থেকে বেরিয়েই শুনতে পাই, আমার বড়ভাই আলামিন তারেক খান হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে আনন্দের দিনটি মুহূর্তে হয়ে গেল সবচেয়ে দুঃখের দিন। সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, জীবনের দুঃখ-বেদনা আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। সেই দুঃখ, কষ্ট আর বেদনা আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আজীবন সম্মাননার ও আজীবন চিকিত্সা ব্যয়ভার বহনের ঘোষণার আনন্দ নিয়ে বাবা আরও সাতটা মাস পার করতে পেরেছিলেন কোনোমতে।
আমি জরুরি কাজে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম, সেটা ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বরের কথা। বাবা তখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। হাসপাতালের ১৪০৮ নম্বর কেবিনের বিছানায়-শোয়া বাবা আমাকে বললেন, ‘কালকে (২৮ নভেম্বর) তো আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিবে, তুই মালয়েশিয়া থেকে ফিরলেই (আমার তিন সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসার কথা) তোকে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা দরখাস্ত দিতে যাব—আমি জীবনের পঞ্চাশটি বছর একটা জরাজীর্ণ বাড়িতে (মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডের বাড়ি) কাটালাম, তিনি অবশ্যই আমার ওপরে সুবিচার করবেন, এখন এই বাড়িটি আমার স্ত্রী-সন্তানদের থাকার জন্য একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিবেন। আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার আবেদন ফেলে দিবেন না।’ এরপর বাবা তখন গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমার অভিনয়-জীবনে পাওয়া পুরস্কারগুলো রাখার আর তো কোনো জায়গা নেই, এই ছোট বাড়িটি ছাড়া। তোদের মা আর আমার জীবনের সব স্মৃতি এই বাড়িটি ঘিরে, তোরা সব ভাই-বোন এই বাড়িটিতে থাকবি।’ বাবাকে আমি বললাম, ‘আমি মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসব তো তিন সপ্তাহের মধ্যেই, তারপরে আপনার সঙ্গে দরখাস্ত নিয়ে আমরা যাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।’ আব্বার অসুস্থতা গুরুতর ভাবে বেড়ে যাওয়ার খবর শুনে আমি ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে এলাম। এসে দেখি, বাবা স্কয়ার হাসপাতালের কেবিনে লাইফ-সাপোর্টে আছেন। আর কিছু করার ছিল না, ৭ ডিসেম্বর তিনি আমাদের সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। আব্বার যখন জীবনের শেষ-মুহূর্ত—আমি তখন তাঁর শয্যাপাশে, ডাক্তার একটা পর্যায়ে লাইফ-সাপোর্ট সরঞ্জাম খুলে নেওয়ার সময়ে আমাদেরকে জানালেন—তিনি আর নেই। আমি হতবাক হয়ে পড়লাম, এই প্রথম বুঝতে পারলাম—জীবনে কী হারালাম! সারাজীবন হয়তো বুঝতেই পারিনি, বাবাকে হারানোর পরের যন্ত্রণাটা কেমন!
সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, আর এখন যত দিন যাচ্ছে, হূদয়-মগজ দিয়ে টের পাচ্ছি—বাবা কতটা জরুরি ছিলেন আমাদের জীবনে। তাঁকে হারানোর বেদনা, এক অসহনীয় যাতনা প্রতিনিয়তই বাড়ছে, তাঁকে কাছে না-পাওয়ার দুঃখের যে বোঝা তা প্রতিনিয়ত আরও ভারী হচ্ছে। বাবাকে হারানোর সেই বেদনা নিয়ে আমাকে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে, সেটাই এক কঠিন বাস্তবতা। আব্বার উদ্দেশে আমার কথা—‘আব্বা, আপনি আমাদেরকে রেখে গেছেন, আম্মাকে রেখে গেছেন, আমরা বিশ্বাস করি, মহান আল্লাহ আপনাকে ভালো রেখেছেন, আপনার জন্য আমরা সবসময় দোয়া করি, মহান স্রষ্টা যেন আপনাকে বেহেশত-নসিব করেন, আমাদের আম্মা ভালো আছেন, আপনাকে আমাদের সবসময় মনে পড়ে। আরেকটি কথা আব্বা—আপনার শেষ বিদায়ের কিছুদিন আগে আপনি আমাকে আর সাংবাদিক অভি মঈনুদ্দীনকে বলেছিলেন, আপনার মৃতদেহ যেন এফডিসিতে না নেওয়া হয়। আমরা আপনার সহশিল্পীদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনি। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপনার ইচ্ছের বরখেলাপ এইটুকু করতে বাধ্য হয়েছিলাম, আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। জীবনে অনেক স্মৃতিই ভুলে গেছি, কিন্তু বাবা, আপনার স্মৃতি একটুও ভুলিনি, ভুলব না কোনোদিন।’
লেখক :প্রয়াত অভিনেতা খলিলের দ্বিতীয় পুত্র, নির্বাহী পরিচালক, রাঙ্গামাটি ওয়াটারফ্রন্ট রিসোর্টস, কালিয়াকৈর