গল্পটা আজ সব বাধা পেরিয়ে লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার। গল্পটা একদল উদ্যমীদের নিয়ে যারা ছাত্রজীবন থেকেই কঠোর পরিশ্রমী, কাজ করছেন পাশাপাশি পড়াশোনাও ঠিক রাখছেন। এ সমাজের কেউ কেউ হয়তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় আবার কারো কারো হয়তো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমাদের শিক্ষার্থীদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা চাকরি করে তাদের পড়াশোনার খরচ যোগান আবার কেউ কেউ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য চাকরি করে থাকেন। হাত খরচের ব্যাপারতো আছেই। এদেশে কে না জানে, চাকরির বাজার ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ঠিক কখন থেকে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া উচিত? অনেকে বলে পড়ালেখা শেষে। অনেকে আবার ছাত্রজীবন থেকেই প্রস্তুতি শুরুর পক্ষপাতী। আমাদের আজকের আয়োজন একদল শিক্ষার্থীকে নিয়ে যারা পড়াশোনা করছেন পাশাপাশি চাকরি করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদেরকে নিয়ে লিখেছেন—
মোঃ আল-আমিন
বাবার কষ্টটা একটু কমাতে চাই
রেশমী চাকমা
ইংরেজি বিভাগ (নবম সেমিস্টার), উত্তরা ইউনিভার্সিটি
খাগড়াছড়ির মেয়ে রেশমী চাকমা। ছোটবেলায় হারিয়েছেন মাকে। বাবার কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছেন তিনি। বাবার স্বপ্ন মেয়ে অনেক বড় হবে। একদিন সবার মুখ উজ্জল করবে। বাবা রেশমীকে ভর্তি করালেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। রেশমী ইংরেজি বিভাগের নবম সেমিস্টারে পড়ছেন। ইট-পাথরের এ আধুনিক শহরে খরচের শেষ নেই। বাবা একজন কৃষক। তার পক্ষে পুরো খরচ চালানো একটু কষ্টসাধ্য বটে। বাবার কথা ভেবে রেশমী রাজধানীর একটি শপিং মলে খণ্ডকালীন চাকরিতে যোগ দেন। রেশমী বলেন, আমার বাবা আমাকে চাকরি করতে বলেনি। তবুও আমি চাকরি করছি বাবার কষ্টটা একটু কমানোর জন্য। বাবার খরচের বোঝাটা একটু হালকা করার জন্য। আসলে পড়াশোনা ঠিক রেখেও চাকরি করা যায়। আমি যে সময়টা গল্পগুজবে কাটাতাম সে সময়টা আমি এখন চাকরিতে ব্যয় করছি। এতে করে আমার কিছু টাকা উপার্জন হচ্ছে।
পরিবারের চাপ মাথার উপর
উবাইদুল ইসলাম
মাস্টার্স প্রথম বর্ষ (ইংরেজি বিভাগ), টঙ্গি কলেজ
উবাইদুল ইসলাম একজন বিসিএস ক্যাডার হতে চান। হতে চান একজন বড়মাপের মানুষ। তার এ লালিত স্বপ্নের ভাঙন ধরে অপরিণত বয়স থেকেই। ছোটবেলায় তিনি তার বাবাকে হারান। তার উপর সংসারের চাপ বইতে থাকে সেই অনার্সের প্রথম বর্ষ থেকেই। বাসায় গিয়ে টিউশনি করতেন। মাস শেষে যে কয় টাকা পেতেন তা থেকে মাকে পাঠানোর পর যা থাকতো তা দিয়ে কোনোরকম তার পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার খরচ চলে যেতো। তিনি এখন পড়াশোনার পাশাপাশি নামকরা একটি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তিনি বলেন, আমি কলেজ জীবন থেকেই টিউশনি করছি। টিউশনি ছাত্রদের জন্য টাকা উপার্জনের একটি ভালো মাধ্যম। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানো যায়। আমি বর্তমানে একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছি, পাশাপাশি বিসিএস-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কষ্ট যতই হোক আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করব।
আমি স্বাবলম্বী হতে চাই
খাদিজাতুল কুবরা শ্রাবণী
বিবিএ শেষ বর্ষ, সিটি ইউনিভার্সিটি
ছোটবেলা থেকেই আমি স্বাধীনচেতা। স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে। কারো উপর নির্ভর করাটা আমার একদম অপছন্দ। পরিবার থেকে পুরোপুরি সাপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আমি নিজে নিজে কিছু একটা করার চেষ্টা করতাম। আমি বিবিএ তৃতীয় সেমিস্টার থেকেই খণ্ডকালীন চাকরিতে যোগ দেই। আমার প্রথম চাকরি গ্রামীণফোনের কাস্টমার ম্যানেজার হিসেবে। সেখানে আমি বেশ সম্মান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করি। বর্তমানে আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানির বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছি। বলছিলেন খাদিজাতুল কুবরা শ্রাবণী। তিনি তার পড়াশুনা ঠিক রেখে চাকরি করছেন। তার মতে, বাবা-মায়ের উপর নির্ভর না করে প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত নিজে নিজে কিছু করার চেষ্টা করা। চাকরির উদ্দেশ্য যে শুধু টাকা উপার্জন তা নয়। বরং এখানে একটি আত্মতৃপ্তি কাজ করে। বাজে আড্ডা কিংবা গল্পগুজবে না মেতে ঐ সময়টা কাজে লাগানো উচিত।
অভিজ্ঞতা অর্জনই আমার কাছে জরুরি
শাওন আহমেদ
ডিপার্টমেন্ট অব সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), শেষ বর্ষ, ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি
শাওন বেশ হেসে খেলে কাটিয়েছেন একে একে স্কুলজীবন, তারপর কলেজ জীবন; এবার শেষ প্রায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। কখনো চাকরি কিংবা কাজের প্রতি মাথা ঘামাননি। সব বন্ধুরা যখন কাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন তিনি গেমস খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কাজের প্রতি মনোযোগ না থাকলেও এবার শেষবর্ষে এসে তার মনে হলো তাকে কিছু একটা করতে হবে। ভালো চাকরি পেতে হবে। শাওন আশপাশ না তাকিয়ে সরাসরি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি এখন পড়াশুনার পাশাপাশি গুগল কোম্পানির একটি প্রজেক্টে চাকরি করছেন। তিনি বলেন, পড়াশুনার পাশাপাশি এটাই আমার প্রথম চাকরি। বেশ উপভোগ করছি। এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আমার কাছে টাকার চেয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনটাই বেশি জরুরি। আমি মনে করি প্রত্যেকটি ছাত্রের চাকরির জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত। এতে করে চাকরি পাওয়ার পথ সহজ হবে।
নিজের উপার্জিত টাকা খরচের মজাই আলাদা
নাজিয়া আফরোজ
ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ভালনারেবেলিটি স্টাডিজ, তৃতীয় বর্ষ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি
রাজশাহীর মেয়ে নাজিয়া আফরোজের বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী। বাবা-মা আর দুই ভাই-বোনের সংসারে বেশ সচ্ছল তারা। নাজিয়া আফরোজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে থাকছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে। চাইলেই বাবা টাকা পাঠায়। কিন্তু বাবার কাছে কত চাওয়া যায়। এবার নিজেরও কিছু একটা করা দরকার। আর নিজের উপার্জিত টাকা খরচ করার মজাই অন্যরকম। নাজিয়া আফরোজ তার পড়াশুনার পাশাপাশি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কনটেন্ট মেকার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমি যখন মাস শেষে টাকা হাতে পাই তখন আমার মনটা আনন্দে ভরে যায়। নিজের ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পারি। আবার বাবা-মাকে কিছু উপহার দেবার চেষ্টা করি। আমি যে শুধু টাকার জন্য কাজ করছি তা নয়। বরং এখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পারছি; যা আমাকে পরবর্তিতে চাকরি পেতে সহায়তা করবে।
নিজের উপার্জনে পড়তে হবে
মো. সোহাগ হোসেন সম্রাট
একাদশ শ্রেণি (বিজ্ঞান বিভাগ), আইইএস স্কুল এন্ড কলেজ
আমারও ইচ্ছে করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। তাদের সাথে গল্পে মেতে উঠি। আমার বন্ধুরা অনেক জায়গায় ঘুরতে যায় কিন্তু আমি পারি না। সবাই যখন ঘুমায় আমি তখন পড়তে বসি। ঠিকমত ক্লাস করতে পারি না। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস করি মাত্র। বলছিলেন সোহাগ হোসেন সম্রাট। সোহাগ ছোটবেলা থেকেই বেশ উদ্যমী। বাবা-মা আর পাঁচ ভাই এক বোনের সংসারে সোহাগের অবস্থান সবার ছোট। পরিবারের অবস্থা ততটা সচ্ছল না হওয়ায় একাদশ শ্রেণি থেকেই কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন। সে তার পড়াশুনার খরচ নিজেই চালায় সাথে তার পরিবারকেও উপার্জিত অর্থ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করে। দোকানে সারাদিন কাজ করে অনেক সময় ক্লাস করতে পারে না। রাতে পড়তে গেলে ক্লান্তি এসে ভর করে সারা দেহে। তবুও সে থেমে নেই। তিনি মনে করেন ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। যতো কষ্টই হোক তাকে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে হবে। তার ইচ্ছা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া।