বরকতুল্লাহ সুজন
ঠিক একশ’ বছর আগে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর শেষ হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপে একটি সংঘাত থেকে তা কতটা ভয়ানক প্রাণঘাতী যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল, তা সবার জানা। পরবর্তীকালে যাতে কমবেশি জড়িয়ে পড়ে শক্তিধর সব ক’টি দেশ। অনেকেই জানেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল। বড়জোর তা তুর্কি সামাজ্যের নাগাল পায়। কিন্তু ওই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সুদূরে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কতটা ব্যাপকতা ছড়িয়েছিল, তা সবার অজানা। ১৯১৪ সাল থেকেই সেখানে ক্ষুদ্র জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে আসছিল বিশাল মিত্র বাহিনী।
ইউরোপে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও পূর্ব আফ্রিকায় তা শেষ হয় আরো দু’সপ্তাহ পর। টানা চার বছর ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পর ২৫ নভেম্বর অস্ত্রবিরতিতে যায় জার্মান বাহিনী ও মিত্র শক্তি। এই অঞ্চল তখন বিভক্ত ছিল ব্রিটিশ, ফরাসি ও জার্মান উপনিবেশে। ইউরোপে ১৯১৪ সালের জুলাইয়ে যুদ্ধ বাধলে ৬ ও ৭ আগস্ট জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে তত্কালীন টোগোল্যান্ড ও ক্যামেরুনে আকস্মিক অভিযান চালায় ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী। যুদ্ধে জার্মান বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এরপর পশ্চিম আফ্রিকায় জার্মান সামরিক কমান্ডার কর্নেল পল ভন লিত্তাও-ভরবেক সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নেন। যাতে সফল হন তিনি। বিশ্ব ইতিহাসে খলনায়ক হলেও সামরিক বা রণ ইতিহাসে এই কমান্ডার একজন দক্ষ যোদ্ধা বলেই বিবেচিত। কারণ বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিজয় হবে, এমন আশায় আফ্রিকায় ব্রিটিশ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন টানা চার বছর। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ২৫ নভেম্বর আত্মসমর্পণ করেন কর্নেল লিত্তাও-ভরবেক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক বিচার নিয়ে তানজানিয়ায় বেড়ে ওঠা শিল্পী কাথলিন বোমানির একটি কথা বেশ সাড়া জাগিয়েছে। তিনি বলেছেন, জার্মানির রাজধানী বার্লিনে এখন যা ঘটছে, তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একশ’ বছরের ফল। ওই যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব আফ্রিকা ছিল জার্মান উপনিবেশ। যা এখন তানজানিয়া, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডি এই তিন দেশে বিভক্ত। এ সব দেশ ভ্রমণ করে যুদ্ধের ইতিহাস খতিয়ে দেখেছেন কাথলিন বোমানি। তিনি জানান, যুদ্ধ কেবল তানজানিয়া, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং বর্তমান মোজাম্বিক ও জাম্বিয়াতেও এই যুদ্ধ চলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশলে। বোমানির মতে, প্রকৃতি ও পরিধির কারণেই এই অঞ্চলে অন্য স্টাইলে যুদ্ধ হয়। এ কারণেই সেখানে যুদ্ধাবস্থা ছিল ইউরোপের চেয়ে কম। তবে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে জার্মান ও মিত্র শক্তি। গ্রামগুলোকে তারা বাধ্য করেছিল রসদ সরবরাহ ঠিক রাখতে। বেসামরিক লোকদেরও সৈন্য বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। হয় সরাসরি যুদ্ধ করতে হবে, না হয় সৈন্যদের রসদ যোগাতে হবে। অধিকাংশ সৈন্য ও সরবরাহকারী আসলে গেরিলা যুদ্ধে নয়, মারা গিয়েছিল পুষ্টিহীনতা, অবসাদ, বিষাক্ত মাছির আক্রমণ ও কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় মাজি মাজি নামক প্রতিরোধ যুদ্ধের ঠিক সাত বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত। বোমানি জানান, কমান্ডার পল ভন লিত্তাও-ভরবেকের গেরিলা রণকৌশলের আসল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ থেকে মিত্র বাহিনীর দৃষ্টি সরানো। যাতে সফলও হন তিনি। কারণ ব্রিটেন নিজ উপনিবেশ ঘানা, নাইজেরিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জ্যামাইকা, উগান্ডা, কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সৈন্যদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। বেলজিয়াম ও পর্তুগিজ বাহিনীর সাথে মৈত্রী স্থাপন করে তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় দেড় লাখ। আর জার্মান বাহিনীর ছিল প্রায় ২৫ হাজার। তবে চার বছরে দু’পক্ষ যে পরিমাণ বাহক নিয়োগ করেছে, তার পরিমাণ ১০ লাখেরও বেশি। সৈন্যরা যেখানেই যেত, সেখানেই লোক নিয়োগ করতো। বলা হয়, বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব আফ্রিকায় মারা গেছে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার মানুষ। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কথা। উপরন্তু রসদ সরবরাহকারীর মৃত্যুর হিসেব করাকে অপরিহার্য মনে করেনি কোনো পক্ষই। এ কারণে হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আফ্রিকায় আসলে কতজন মারা গেছে!
বোমানি জানান, একশ’ আগের গেরিলা অভিযান বা যুদ্ধে সৈন্য বাহিনীর পথ অনুসরণ করে সব ক’টি দেশ সফর করেছেন তিনি। তবে সরকারিভাবে সংরক্ষিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যদের কোনো সমাধির খোঁজ মেলেনি। এমনকি সংরক্ষণ করা হয়নি যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতি বরং জার্মান বাহিনীর ব্যবহূত উপনিবেশিক ভবনগুলো এখনও টিকে আছে। আছে লিন্দির দুর্গ ও জার্মান গভর্নরদের তাক লাগানো পরিত্যক্ত ভবনগুলো। যা খোদাই করা পাথরমুর্তি দিয়ে সাজানো। ক্ষয়ে যাওয়ার জন্য এগুলো তৈরি হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি ও মানুষের মর্মদশা নিয়ে লিখতেন ব্রিটিশ মিশনারিরা। অনেক পুরোনো গানেও উঠে এসেছে সেই সব যুদ্ধস্মৃতি। বোমানি মনে করেন, এগুলো ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল হতে পারে। তিনি বলেন, ইউরোপ যেখানে বিশ্বযুদ্ধের একশ’ বছর স্মরণ করছে। আফ্রিকায় সেই স্মৃতি হাতড়ানো সবে শুরু হয়েছে।