ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটে, দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি বন্ধ, তাও প্রায় বছর পনের হলো। স্কুল-কলেজেও চরম অবহেলায় ক্রীড়া। ফলে সামাজিক নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মেয়েদের জন্য খেলা বাধ্যতামূলক’! বাংলাদেশেই! অবিশ্বাস্য? মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল করতে ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম শহরের খালেদ সড়কে কার্যক্রম চালু হয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন্স (এইউডব্লিউ)। নিয়মরক্ষা না, খেলাধুলায় অংশ নেয়া নিশ্চিত করতে নিয়মেও কঠোরতা, খেলায় পাস না করলে সনদ বন্ধ! কঠোর নিয়মের কারণে ইচ্ছা না থাকলেও অন্তত একটা খেলায় অংশ নিতে বাধ্য নেপালের ক্রান্তি জোশী, নেহা ইয়োহান, আফগানিস্তানের ফারিশতা আফজালিরা। খেলার ভালো পরিবেশও রয়েছে; আছেন ভালো মানের প্রশিক্ষকও। শারীরিক সুস্থতার জন্য রয়েছে আধুনিক জিম। তবে প্রশিক্ষণের নির্দিষ্ট সময় পান না শিক্ষার্থীরা, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে খেলতে হয়।
জায়গার অভাবে আপাতত কারাতে, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল ও ক্রিকেট পাঠ্যক্রম রয়েছে। ক্রিকেট ও ভলিবলের অনুশীলন হয় সিডিএর মাঠে। অতিরিক্ত পাঠ্যক্রমে রয়েছে ফুটবল ক্লাব ও সাইক্লিং ক্লাব। ‘অদূর ভবিষ্যতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে (শহরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় ১৩৬ একর জমি বন্দোবস্ত দিয়েছে সরকার) কার্যক্রম শুরু হলে খেলার সংখ্যা বাড়ানো হবে’- জানান প্রতিষ্ঠানের সহযোগী পরিচালক সেনসাই মারিয়া চক্রবর্তী। জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতা একাধিক স্বর্ণপদক জিতেছেন মারিয়া। আত্মরক্ষায় নারীদের গঠন করতে প্রথম বর্ষে কারাতে বাধ্যতামূলক সকল শিক্ষার্থীদের জন্য। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এইউডব্লিউর ১১ জন ব্ল্যাকবেল্ট পেয়েছে। ২০১১ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে চট্টগ্রামের হয়ে অংশ নিয়ে একজন রুপা ও দু’জন ব্রোঞ্জ পেয়েছে। এই কারাতে-ই পরীক্ষামূলক ভাবে পাঠ্যক্রম করা হয়েছিল। নেপথ্য কারণ বলেন মারিয়া চক্রবর্তী, এখানে চার বছরের কোর্স শেষ করে মেয়েরা তৃণমূল পর্যায়ে দুর্গম এলাকায় কাজ করতে গিয়ে ছিনতাইসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে খেলাটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।’
সতীর্থ ক্রান্তী জোশীর আগ্রহ বাস্কেটবল, টেবিল টেনিস, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনে। কারাতে, বাস্কেটবল খেলেন নেহা। কারাতে, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন খেলেন আফগান কন্যা ফারিশতা। ব্যাডমিন্টনকে পেশা হিসেবে নিতে চান তিনি! ‘কাবুলের স্কুলে পড়াশোনা করার সময় খেলাধুলার কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না, এখানে সব কিছু পাচ্ছি’- জানান ফারিশতা। অ্যাথলেটিক্সে বেশ দক্ষ লিকলিকে গড়নের ক্রিস্টিনা। নিজেকে ‘১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে খুব ভালো’— দাবি করলেন তিনি।
প্রায় সব খেলায় রয়েছে জাতীয় বা প্রদেশ দলে খেলা খেলোয়াড়। বাস্কেটবলের রুমেশি পেরেরা খেলেছেন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলে। ব্যাডমিন্টনে আছেন প্রাদেশিক দলে খেলা কম্বোডিয়ার থামি, ভারতের আজরা। ২০১২ সালে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার আন্তঃজেলা ব্যাডমিন্টনের দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন নাজমা ইসলাম ও মোস্তারী পারভীন। ২০০৬ সালে ঢাকায় ফজিলাতুননেসা মুজিব আন্তর্জাতিক কারাতে টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছেন নেপালের ক্রিস্টিনা তামাং।
হতাশার কথা হলো নিয়মিত অনুশীলন করলেও খেলার সুযোগ কম। বিদেশি হওয়ায় চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা বা জাতীয় কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে পারেন না তারা। জাতীয় না হোক খেলতে চান স্থানীয় পর্যায়ে। বিদেশি কোটায় বিভিন্ন ক্লাবে খেললেও আর্থিক সুবিধা পান না মেয়েরা, প্রতিভা বিকাশের স্বার্থে খরচ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ই। আবার বিভিন্ন ইভেন্টে খেলার অনুমোদন নিতে চাইলেও দিচ্ছে না জেলা ক্রীড়া সংস্থা! জানা গেছে— বছর দশেক ধরে নতুন কোনো ক্লাব বা সংস্থা অন্তর্ভুক্ত করেনি তারা! তারপরও খুশি নারী শিক্ষার্থীরা। আফগান কন্যা ফারিশতা আফজালির ভালো লাগে সাইক্লিং। জনসচেতনতায় কিছুদিন আগে ৩০ জন মিলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গেছেন সাইকেল চালিয়ে। সবশেষে একটা কথাই বললেন সবাই- এই প্ল্যাটফর্মে এসে আমরা বিভিন্ন দেশের মেয়েরা এক কাতারে আসতে পেরেছি।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ার ১৩০জন নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয় নারী শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির। এসব দেশ ছাড়া বর্তমানে আফগানিস্তান, ভুটান, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিস্তিন, চীন, সিরিয়া ও ভিয়েতনাম মিলিয়ে ৫০০’রও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।