যখন আমাদের ছোট্ট পা-দুটি সবে হাঁটতে শেখে, তখন ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটার সঙ্গেই আমরা অপরিচিত থাকি। অথচ তখন থেকেই আমরা আমাদের অজান্তে জড়িয়ে পড়ি বন্ধুত্বের সম্পর্কে। প্রতিবেশী সমবয়সীদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। এরপর আমরা যখন স্কুলজীবনে পদার্পণ করি, তখন পরিচিত হই ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটার সঙ্গে। সহপাঠীদের মধ্য থেকে পেয়ে যাই কিছু বন্ধু। ছোটবেলায় বন্ধু মানে আমরা বুঝতাম—ক্লাসে সবসময় একসঙ্গে বসা, একসঙ্গে খেলা করা, নিজের টিফিনের ভাগ থেকে বন্ধুকে খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এরপর আমরা যতই বড় হতে থাকি, বন্ধুত্বের মধ্যে যোগ হতে থাকে আরও নতুন নতুন বিষয়। দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা, বিশ্বাস ও আন্তরিকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানবীয় গুণ জড়িয়ে পড়ে বন্ধুত্বে। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বন্ধুদের প্রভাব অপরিসীম। তবে কালবিশেষে এই প্রভাবে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। আগেরকার সময়ের সঙ্গে এখনকার সময়ের বন্ধুত্বের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আগে বন্ধু মানেই ছিল নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, মাসে একটা কিংবা দুটো চিঠি আদান-প্রদান করা।
বন্ধুদের হাতে লেখা সেসব চিঠিতে থাকত কত খবর, কত আন্তরিকতা! আবার অনেকদিন চিঠি না পেলে অভিমানী ভাষায় বন্ধুকে অভিযোগ দেওয়াও ছিল নিত্যনৈমিত্তিক একটা বিষয়। কিন্তু কালের আবর্তনে চিঠির ব্যবহার কমিয়ে আমরা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছি ফেসবুক, টুইটারের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দূরত্ব কমিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে কমিয়েছে আমাদের আন্তরিকতাও। এখন আর চিঠির জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় না কিংবা বন্ধুর জন্য লেখা হয় না পাতার পর পাতা চিঠি। এখন শুধু প্রয়োজন পড়লেই গুটিকয়েক শব্দে বন্ধুকে স্মরণ করা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আড্ডা ও বন্ধুদের সঙ্গ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আধুনিক হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভিন্ন মাত্রা এনেছে। এখন আর সবুজ ঘাসে বন্ধুদের আনাগোনা দেখা যায় না। ছায়াঘেরা নিরিবিলি রাস্তাগুলোও আর বন্ধুদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে না। তবুও সবাই দাবি করে তারা ভালো বন্ধু! প্রযুক্তির অপব্যবহারই আজ বন্ধুত্বের সংজ্ঞাকে এতটা সহজলভ্য ও সস্তা করে তুলেছে। যদিও বা মাঝেমধ্যে পাঁচ-ছয়জন বন্ধুকে একত্রিত হতে দেখা যায়, তখন তারা পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তার চেয়ে মোবাইলেই ব্যস্ত থাকে বেশি। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের আন্তরিকতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রমেই প্রযুক্তিমুখী হয়ে পড়ছি, যা আমাদের নিজেদের অজান্তেই বন্ধুত্বের সম্পর্ককে ফিকে করে তুলছে। এসবের মধ্যেও আজকাল হাতেগোনা দুই একটি ভালো বন্ধুত্ব দেখতে পাওয়া যায়, যাদের আন্তরিকতা কেবলমাত্র মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তারা সবুজ ঘাসে কিংবা টংয়ের দোকানে চায়ের কাপ হাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাতে, বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বেরিয়ে পড়ে অজানাকে জয় করার উদ্দেশ্যে!