
সাইফুল ইসলাম জুয়েল
(গত সংখ্যার পর থেকে)
৬.
‘এই দুর্ভোগ কত দিনের?’ নিজেকে প্রশ্ন করে আতর আলী। উত্তর খুঁজে পায় না সে। কারো থেকে যে জানবে সেই সুযোগও বোধহয় নেই!
হঠাত্ করেই একদিন দারুণ এক আবিষ্কার করে বসে আতর আলী। খুশিতে বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের মতো ‘ইয়াহু ইয়াহু’ বলে চিত্কার করে ওঠে সে। আসলে, ‘হাম্বা সং’টা সে গাইতে জানে। সেটাই রাজাকে গেয়ে শোনানোর আইডিয়া এসেছে তার মাথায়। তাতে যদি রাজা মশাই গরু-ছাগলের পাশাপাশি তার প্রতিও সহানুভূতিশীল হয়!
তাছাড়া, আরেকটা খুশির খবর হলো—আতর আলী এ ক’দিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না হওয়ায় আর মারাত্মক টেনশনে ভুগে ভুগে একেবারে চিকন হয়ে গেছে!
যখন সে খুশিতে চিত্কার করছিল, ঠিক ওই মুহূর্তে চোরদের এক প্রহরী ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল। থমকে গেল সে। ত্বরিত্ একটা ডিভাইস বের করে কতক্ষণ টিপাটিপি করে শেষে উত্তেজিত ভঙ্গিতে আতর আলীর সামনে এসে দাঁড়াল। তাতে ‘ইয়াহু’ সার্চ ইঞ্জিন বের করা। চোরদের ওই প্রহরী ইংরেজিতে আতর আলীকে জিজ্ঞাসা করল, সে এটা চেনে কি না!
আতর আলী কখনো ইয়াহু ব্যবহার করেনি। সে গুগলের একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই মন খারাপ করে দু পাশে মাথা নাড়ল। তারপর, আবারও ‘ইয়াহু ইয়াহু’ বলে চিত্কার করে উঠল।
চোরদের ওই প্রহরী এবারও ইংরেজিতে জানতে চাইল, ‘তুমি ‘ইয়াহু কী’ তা জানো না, তবে ইয়াহু ইয়াহু বলে চিল্লাচ্ছ কেন?’
আতর আলী কী আর সাধে চিল্লাচ্ছে, সে জেনে গেছে—এরা যে ইংরেজি জানে! মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ফেল করলেও এই ভাষায় যে সে গরু চোরদের সঙ্গে তার মনের ভাব বিনিময় করতে পারবে, সেটাই তার কাছে অনেক বড় কিছু।
এরপর আতর আলী সেই প্রহরীর কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিল। তারা আসলে কোনো চোর নয়। এলিয়েন! পৃথিবী থেকে বহুদূরের এক গ্রহে বসবাস তাদের। কথাটা অবশ্য আতর আলী বিশ্বাস করেনি প্রথমে। সে যাহোক, এলিয়েনরা নাকি বহু বছরের সাধনার পর পৃথিবীর একটা ভাষার কোড উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সেটা হলো—ইংরেজি ভাষা। এরপরই তারা পৃথিবীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোনো এক গোলযোগে ইংরেজিভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে না গিয়ে বাংলাভাষী অঞ্চলে গিয়ে উপস্থিত হয়। ওখান থেকে পৃথিবীতে বসবাসকারী দুটি প্রধান জাতির (এলিয়েনদের মতে, পুরুষ জাতি ও স্ত্রী জাতি) নমুনা আনতে গিয়ে ওই গরু আর ছাগল দুটিকে নিয়ে আসে। আতর আলীকে তাদের পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না। তবুও ফ্রি হিসেবে যখন তারা তাকে কাছে-পিঠে পেয়েছে, তাই সঙ্গে করে নিয়ে নিল আর কী! ভেবেছে, আতর আলী হয়তো তাদের (গরু-ছাগলদের) কোনো অনুগত প্রাণী (গবাদি পশু!) হবে।
এলিয়েনরা পৃথিবীতে যাওয়া মাত্রই তাদের ডিভাইসে একটা ওয়াই-ফাই আপনাআপনিই কানেক্ট হয়ে যায়। সেটির নাম ‘ফাউ আর কত খাবি!’ আতর আলীর মনে পড়ল—তার মোবাইলের ওয়াই-ফাইয়ের নাম এটা। তখন নিশ্চয়ই কোনো কারণে চালু করা ছিল। চটজলদি মোবাইলটা বের করে ডাটা চেক করল সে। ভীষণ কান্না পেল তার। এক বাইট ডাটাও অবশিষ্ট নেই! সবটা যে এলিয়েনরা খেয়ে বসে আছে! যাহোক, এলিয়েনরা তার এই ‘ফাউ আর কত খাবি’ কথাটির মানে উদ্ধার করতে গিয়ে দেখে তাদের ডিভাইসে আপনাআপনি ইয়াহুর অ্যাপ ডাউনলোড হয়ে গেছে। তাতে ঢুকে তারা হঠাত্ একটা গান পেয়ে যায়—দ্যা হাম্বা সং! সেই হাম্বা সংগীতেরই কোনো একটা শব্দ (হাম্বা) শুনেছে তারা মিস্টার গরুর মুখ থেকে! তাদের ধারণা—গরুটা হয়তো তেমন একটা গাইতে জানে না। এমনটা তো হয়ই। সবাই তো আর গায়ক না।
সেদিন সেই হলরুমে রাজা জানতে চেয়েছিল, ‘তোমাদের দুজনের (গরু ও ছাগলের) মধ্যে স্ত্রী লিঙ্গের কোনজন?’ কাকতালীয়ভাবে এলিয়েনরা বলদ গরু আর ছাগী ছাগল নিয়ে আসে। তখন নাকি ছাগলটা রাজার প্রশ্নের উত্তর দেয়, ‘মে!’
ছাগলের পেটে বাচ্চা। রাজা তা বুঝতে পেরে জানতে চান, ‘তুমি কোনো মাসে গর্ভধারণ করেছ?’ ছাগলটা আবারও উত্তর দেয়, ‘মে’।
তখন তারা সেই কার্ডে লেখা পৃথিবীর ক্যালেন্ডার বের করে দেখে, সত্যিই মে মাস পার হয়ে গেছে। গরু-ছাগলের মুখে ইংরেজি শুনে এলিয়েনরা বেজায় খুশি। পৃথিবীবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বিপ্লবসাধন করে ফেলেছে তারা! তবে, পৃথিবীবাসী এখনো অনুন্নত। তাদের ভাষাও বিকাশ লাভ করেনি পরিপূর্ণভাবে। এরা (গরু-ছাগল দুটি) এক্ষেত্রে তাদের ভীষণ সাহায্য করেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই নাকি তাদেরকে রাজকীয় সংবর্ধনা আর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।
আতর আলী আরো জেনেছে, রাজার মাথার ওই মাণিক্যটা অনেক মূল্যবান। ওটা দুর্লভ এবং এই গ্রহে ওটি এক পিসই রয়েছে। ওদিকে, রাজা মশাইয়ের ধারণা, আতর আলীকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সে খালি মোটা থেকে চিকনাই হতে জানে!
আতর আলী প্রহরী এলিয়েনকে অনুরোধ করল, সে যেন রাজার কাছে গিয়ে তার কথা বলে। রাজার সঙ্গে তার জরুরি কথা আছে। তখন প্রহরী এলিয়েন জানায়, রাজার সঙ্গে কথা বলার এখতিয়ার তার নেই। আর কথা বলা কোনো প্রাণীর (আতর আলীর) কথা অন্য কারো কাছে বললে, কেউ তা বিশ্বাসও করবে না। উল্টো গর্দান যাবে তার। প্রহরী আরো জানায়, কথা বলতে পারলে, সেদিন রাজদরবারেই মুখ খোলা উচিত ছিল আতর আলীর। এখন বললে বরং অন্যরা ধরে নেবে—আতর আলী হয়তো পাখিদের মতো কিছু কিছু শব্দ শিখে নিয়েছে, তাও এখানে (এলিয়েনদের গ্রহে) এসে!
সব শুনে আতর আলী আরেকবার অজ্ঞান হয়ে গেল!
৭.
এলিয়েনরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা আতর আলীকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবে। তারা আগেই জেনেছে, পৃথিবীতে আতর আলীর মতো প্রাণীর অভাব নাই। তারা ধরে নিয়েছে, আতর আলী একটা ছারপোকা বিশেষ! এলিয়েনদের গ্রহেও নাকি ছারপোকার অভাব নেই। আর পৃথিবীতে অভাব নেই আতর আলীর সগোত্রীয়দের! তারা (মানুষ) এলিয়েনদের ছারপোকার মতোই পৃথিবীর মূল প্রাণীর (গরু-ছাগলের) শরীর থেকে তরল (দুধ) শুষে খায় (নেয়)!
আতর আলীকে পৃথিবীতে পাঠাতে বুদ্ধিমান এলিয়েনরা একটা পয়সাও ব্যয় করল না। কোনো স্পেসশিপেরও ব্যবস্থা করল না তারা। আতর আলীকে তারা একেবারে বিনামূল্যে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিল!
একটা গ্রহাণু পৃথিবীর দিকেই ধেয়ে যাচ্ছিল। আতর আলী পরে জেনেছে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা সেটির নাম দিয়েছিল ‘স্বর্গীয় প্রাসাদ’। সেই স্বর্গীয় প্রাসাদ বা হ্যাভেনলি প্যালেসে চাপিয়ে দেওয়া হলো আতর আলীকে। দুরু দুরু বুকে তাতে চড়ে একেবারে কাঠ হয়ে বসে রইল আতর আলী।
ভীষণ ভয় নিয়েই আতর আলী একসময় পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে উপস্থিত হলো। স্বর্গীয় প্রাসাদটা সাগরের বুকে আছড়ে পড়ল। তার আগেই অবশ্য আতর আলী লাফিয়ে পড়েছিল। তাই স্বর্গীয় প্রাসাদটি কোণাকুনিভাবে গভীর সমুদ্রে আছড়ে পড়লেও, আতল আলী গিয়ে পড়ল সমুদ্রের মাঝের এক দ্বীপের কাছাকাছি জায়গায়।
সাঁতরে তীরে গিয়ে উঠল সে। সমুদ্র তটে উঠে আতর আলী হঠাত্ দুজন মানব-মানবীকে দেখে চমকে ওঠে। ‘এদেরকে কোথায় যেন দেখেছি!’ বারবার ভাবলেও তাদের পরিচয় উদ্ধার করতে পারল না সে।
দ্বীপ ছেড়ে মূল স্থলভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য আতর আলী সেই দ্বীপের জাহাজঘাটে গেল। একটা জাহাজ প্রায় ছাড়বে ছাড়বে এমন অবস্থা। আতর আলী দৌড়ে গিয়ে সেটায় চেপে বসল। লোকজন তাকে আটকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আতল আলী এখন চিকনা আলী। সে সুড়ুত্ করে লোকজনের ফাঁক গলে ঠিকই জাহাজে উঠে পড়ল।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
কার্টুন সোহেল আশরাফ
ফজর | ৪:৫৬ |
যোহর | ১২:০৯ |
আসর | ৪:২৭ |
মাগরিব | ৬:০৯ |
এশা | ৭:২১ |
পড়ুন |