ভিন্ন চোখে’র এবারের সংখ্যা নিয়ে প্রতি সপ্তাহের মতো ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আশীষ সৈকত দা’র সাথে আলাপ আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো এবারে গেল সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ঢাকা সফর নিয়েই মূল ফিচার সাজানো হবে। তবে যেহেতু রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুসঙ্গ নিয়ে একাধিক রিপোর্ট এরই ভেতরে প্রকাশিত হয়েছে। তাই আমরা তার এই সফরের সাথে থাকা ক’জন গুণী শিল্পী-সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা জানাবো পাঠকদের। সেই মতে ফেসবুকেই এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নীদি (মুন্নী সাহা)কে জানাই। তার কাছে একটি লেখার আবদার করি। বেশ ক’জন তারকা শিল্পীদেরও অনুরোধ জানাই লেখা দেবার জন্য। দু’দিন বাদে তার কাছে ঠিক গত্বাঁধা লেখা নয়, একটি চিঠি পাঠান মুন্নী সাহা। তাকে জানাই, ‘আমাদের সম্পাদক ভিন্ন চোখে নামের এই বিভাগটিই করেছেন প্রথা ভেঙে কিছু ভিন্ন ঢঙের লেখা ছাপানোর জন্য, যা সুপাঠ্য এবং বাংলাদেশে এই ধরনের ফিচার পাতা এটিই প্রথম। সেই কথামতেই এফবি ইনবক্সে মুন্নী সাহার লেখা খোলা চিঠিটিই হুবহু প্রকাশ করা হলো। সাথে ক’জন তারকারাও জানালেন এই সফরে বিভিন্ন আড্ডা অনুষ্ঠানে থাকার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে। -তানভীর তারেক, বিভাগীয় সম্পাদক
তানভীর,
সেদিন ইন্ডিয়া হাউজে মমতা ব্যানার্জীর রিসিপসন নিয়ে আমার একটা লেখা চেয়েছো। তোমার কানে গেছে যে সেদিন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হয়ে বসেছিলেন। স্টেজের ওপরে নয়, রীতিমতো পা দুলিয়ে, রোয়াকে বসার ভঙিতে। আর ওখানেই একে একে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, মওদুদ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, আসাদুজ্জামান নুরসহ সব রাজনীতির বাঘ-মোষ এক কাতারে বসলেন। রোয়াকে বসার ভঙিতেই। দিদির হাতে মাইক্রোফোন... আয় রে আমার বকুল ফুল, আয়রে আমার টগরফুল বলে ছোট বেলায় আমরা যেমন ‘বউ টোকা’ খেলতাম, দিদি সেই ভঙিতে ডাকছেন, আমার ইন্দ্রনীল কই রে.. ইন্দ্র! আয়, গানটা ধরতো তাকধুম তাকধুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল! স্টেজে গিয়ে দিদির একান্ত বাধ্য ভাই, বিনীত ভঙিতে গাইলেন। সাথে সাথে আওড়ালেন দিদিও। মমতা দিদি একই ভঙিতে কখনো দেব
(কলকাতার নায়ক) কখনো ফেরদৌস (ঢাকার নায়ক), কখনো কবি সুবোধ সরকার, কখনো আসাদুজ্জামান নুর... এমনি করে মঞ্চে তুললেন, গান-কবিতা, বা সিনেমার ডায়লগ আওড়াতে। মাঝে মাঝে পশ্চিমবঙ্গের মমতা দিদি নজরুল অথবা মুকুন্দদাশের চরণ আওড়ান। ছোট্ট স্টেজমতন বেদীটা ধরে, পুরোটা একটা সার্কেল হলো, একটি করে চেয়ার যুক্ত হয়ে। সেখানে বাংলাদেশ আর ভারতের গণ্যমান্য সুধীজনরা। পাক্কা দেড়ঘণ্টা এই আনন্দ সন্ধ্যা দিদির সঞ্চালনায়। আমি স্বভাবসুলভ ফোড়ন কাটছিলাম দূর থেকে ‘দিদি, বাংলাদেশে টকশো এখন ভীষণ পপুলার, টকশো করে ফেলেন, সব্বাই তো আছেই। সবচে পপুলার শো হবে...। আমার এই ফিসফিসানি ঠাট্টা, শুনে আলমগীর ভাই (নায়ক) বললেন, তোমাদের টেলিভিশনে এসব দেখানো উচিত। বল্লাম, কী? উনি বললেন, এই যে তার মতো একজন নেতার সারল্য, কী সাধারণ.. কী মমতা! সত্যিই মমতা... আলমগীর ভাইয়ের কথায় দ্বিমত করলাম না। কিন্তু মনে মনে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিলাম আরেকজনকে। অসাধারণ সাধারণত্ব নিয়ে যিনি আছেন আমার শ্রদ্ধার পরতে পরতে। তিনি শেখ হাসিনা। বিশ্বাস করো তানভীর, দু’দিন আগেই আমি আমার এক বন্ধুকে বলছিলাম, আমাদের বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতার সাথে প্রফেশনাল পরিচয় আমার। কাজের মধ্যে কখনো কখনো তাদের যে অসাধারণ মানবিক কোয়ালিটি দেখেছি, তা যদি বলতে বা লিখতে পারতাম! বন্ধুটি বললো লেখেন না কেন? ক্যামনে লিখি বল! আমি যদি লিখি আমাদের প্রধান মন্ত্রী ও আমার সোনার বাংলা গাইতে গাইতে বুকের বা পাশে হাত রাখেন। আজিমপুর স্কুলের পূর্ণমিলনিতে বন্ধুদের সাথে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে আমাকে একটা আচারের প্যাকেট খুলে দিয়েছেন, সেফটিপিন দিয়ে খুঁচিয়ে। সাথে হাল্কা ঝারি ‘হাতে পায়েই লম্বা এইটা!’ মঞ্জু ভাই (পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) আমার অনেক পছন্দের। তার সাথে আড্ডা দিতে ভীষণ ভাল্লাগে। মঞ্জু ভাই যখন বঙ্গবন্ধুর নানা খুনসুটি আর caring-এর গল্প করেন আমি আমার সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হাতে গোনা কয়েকটি ব্যক্তিগত দেখা হবার ঘটনা মিলিয়ে ফেলি চট করে। মনে পড়ে ২১ আগস্টের ঘটনার পর প্রথম রিপোর্টার আমি, যাকে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন। সুধাসদনে সিঁড়ির গোড়ায় আমাকে দেখে একটা সিঁড়ি পারা না দিয়ে ঝাপ দিয়ে নেমে সে কি কান্না! দু’গালে চুমু খেয়ে বলেছেন, বেচেঁ আছিস, আমি তো ভাবছিলাম.... লিবিয়ার যুদ্ধ কাভার করার সময় তার ফোন পেয়ে অভিভূত আমি! শাসনের গলায় বলেছেন... বেশি সাংবাদিকতা দেখানোর দরকার নাই, লিবিয়ায় এখন সরকার নাই কিছু নাই, আমাদের এ্যাম্বাসির কেউ নাই... কিছু হলে?
তার ভালোবাসা, caring, উপদেশ এবং ধমক-এর বহু উদাহরণ আছে। হয়তো আরো হবে। অনেকেই যখন মমতা, মোদি বা হিলারি ক্লিনটনের উদাহরণ বা নেতার সাধারণত্ব নিয়ে প্রশংসা করে, তুলনা করে আমার তখন এসব বলতে ইচ্ছা হয়। কাছের জিনিস, আমি চোখে ভালো দেখি না। তাই হূদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। আর দুরেরটা দেখি। নেতার অসাধারণত্ব তাই আমার হূদয় দিয়ে দেখা হয়, আর টেলিভিশনে কাজ করার আদিখ্যেতায়, অনেক কিছু জানাতে দেখাতেও সাধ হয়। কিন্তু পারি না। এর কারণ দুটো। যদি আমি শেখ হাসিনার এসব কোয়ালিটি বা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখি তাহলে তার দলের লোকেরা বলবে আমি ফায়দা নেয়ার জন্য এবং তারা আমাকে আর কোনোদিন সংবাদ সম্মেলনেও ঢুকতে দেবে না। একই ব্যাপার খালেদার লোকেরাও করবে। অন্যদিকে, সো কল্ড নিউট্রালিটি! একজন রিপোর্টারের সাথে একজন প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সম্পর্ককে সাংবাদিকতার মানহানি বলে চালান দেয়ার জন্যে সুশীল সমাজ বসে আছেন। আমি ডরাই, তখন আমার ভালোটা কখনো ভালো থাকবে না, তার সাথে ‘আওয়ামী, ছাত্রলীগিয়’ জাতের গালি থাকবে। আর খারাপটা সব শেখ হাসিনার কপালে। তাই, এই বাস্তবতায়, আমার হাত নিশপিশ করে, বলতে ইচ্ছা করে আমাদের দিদির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ঔদার্য্য আর অসাধারণ সাধারণত্বের কথা। আমার প্রাণের চোখ দিয়ে অনুভব করা, কাছের জিনিস বা মানুষকে দূরের মানুষের সাথে তুলনা করতে ইচ্ছা হয়। তোকে বল্লাম। আবার ভাবি, বড় হলে লিখবো। কিন্তু তখন তো এই মানুষগুলো থাকবেন না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুষ্টু লোকেরা বলেন, তিনি নাকি মৃত মানুষদের স্মৃতিচারণ করেন। যাতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে! আমারও এ অবস্থা হতে পারে... থাক! সব কথা বলার জন্য নয়, লেখার জন্যও নয়। আমরা আমাদের নেতাদের যতই অমানবিক, অহঙ্কারি, নানা অভিধায় ডাকি না কেন তারা বাংলার আত্মা। bangalee soul নিয়ে পাশ্চাত্যে গবেষণা হয়, জানিস? আমরাই শুধু দেখি না, দেখাই না, ভালোটা ভালো বলি না। শুধু নিজের ঢোল... যা কিছু ভালো......। ভালোবাসা। দিদি...