পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে তিন হাজার পাহাড়ি সন্ত্রাসী। এরা জেএসএস, ইউপিডিএফসহ পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন আঞ্চলিক দল ও গোষ্ঠীর সদস্য। এদের ভাণ্ডারে রয়েছে রয়েছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। রয়েছে সামরিক পোশাকের আদলে কমব্যাট পোশাক, ওয়াকিটকিসহ নানা সরঞ্জাম।
স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নামে তারা অবাধে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজির হাত থেকে উপজাতি, বাঙালি কেউ বাদ যাচ্ছে না। এই সন্ত্রাসীরা তিন পাবর্ত্য জেলা থেকে প্রতি বছর ৪০০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে। চাঁদার বেশির ভাগ টাকা অস্ত্র কেনার কাজে ব্যবহার করছে। অস্ত্র আসছে ভারতের মিজোরাম হয়ে মিয়ানমার থেকে।
একটি সরকারি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইউপিডিএফের সামরিক শাখার তিনটি কোম্পানি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, জাগুয়ার কোম্পানি (খাগড়াছড়ি), ড্রাগন কোম্পানি (রাঙ্গামাটি) ও ঈগল কোম্পানি (বাঘাইছড়ি)। এদের কাছে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ ও এম-১-এর মতো ভয়াবহ অস্ত্রসহ প্রায় এক হাজার অত্যাধুনিক ও ভারী আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তবে এদের কোনো স্থায়ী সামরিক ক্যাম্প নেই। সবগুলোই ভ্রাম্যমাণ। এসব মারাত্মক অস্ত্রের বিপরীতে বাঙালিদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে বাঙালিরা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের অস্ত্র বাহক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া চাঁদা সংগ্রহ, সোর্স হিসেবে বাঙালিদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণ করে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনীর সদস্যরা। আর ওইদিনই প্রসীত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ানে শত শত কালো পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানকে ধিক্কার জানায়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, শান্তি বাহিনীর অস্ত্র আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি ছিল মূলত লোক দেখানো। তারা ওইদিন মাত্র ১০ শতাংশ অস্ত্র জমা দিয়েছিল যার অধিকাংশই ছিল জরাজীর্ণ ও ভাঙাচোরা। বাকি ৯০ শতাংশ অস্ত্রই তারা নিজেদের গোপন আস্তানায় মজুদ করে রেখেছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তারা ওইসব অস্ত্র পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের কাজে ব্যবহার করেছে।
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসের সাথে শান্তি চুক্তি হলেও বর্তমানে আধিপত্য বিস্তারের জেরে একটি সংগঠন থেকে চারটি সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রসীত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। পাহাড়ে নতুন করে শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। এসময় থেকেই পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক চাঁদাবাজি, হত্যা ও অপহরণের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে মাঝে মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হতে থাকে তারা। এতে প্রাণ হারায় বহু নেতাকর্মী।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরের মাথায় ইউপিডিএফ ভেঙে যায়। গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রসীত-রবি’র নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এসে তপন জ্যোতি বর্মাকে আহ্বায়ক ও জলেয়া চাকমা তরুকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় ১১ সদস্যের ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দল। আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে গত কিছুদিন আগে তপন চাকমাসহ ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর অনেক নেতাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। অনেক নেতা বিদেশে আত্মগোপন করে রয়েছেন।
ইউপিডিএফের (প্রসীত-খীসা) সম্পদ প্রসঙ্গে একটি সূত্র জানায়, চাঁদাবাজির মাধ্যমে শুধু ইউপিডিএফের বার্ষিক আয় ৫০-৬০ কোটি টাকা। এ টাকা তারা অস্ত্র ক্রয়সহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় করে থাকে। কিন্তু এর বাইরে পার্টির নেতৃবৃন্দ এই অর্থ লুটপাট করে নিজেরা সম্পদের মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। সম্প্রতি এক নেতার বাড়ি থেকে ৮০ লক্ষাধিক টাকা উদ্ধার হয়। ইউপিডিএফ তাদের সঞ্চয়কৃত অর্থ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করে না। তবে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে বা তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে থাকে। ইউপিডিএফের দু’টি গঠনতন্ত্র রয়েছে। একটি গঠনতন্ত্র তারা জনগণ ও কর্মীদের মাঝে প্রকাশ করে। অন্য গঠনতন্ত্রটি পার্টির ৫/৬ জন সিনিয়র নেতা ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। প্রকাশ্যে যাই বলুক প্রকৃতপক্ষে সংগঠন পরিচালিত হয় ঐ গুপ্ত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। প্রয়োজন পড়লে ইউপিডিএফ তার নিজ কর্মীকেও মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করে না।
ইউপিডিএফ সবুজ বনভূমি রক্ষা বা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার নামে জুম চাষ বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি রাবার গাছ, সেগুন গাছ ও বাগান সৃজন করা বন্ধ করে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জুম্ম জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা এবং জনগণকে শারীরিক নির্যাতন ও হাজার হাজার টাকা আর্থিক দন্ডে দন্ডিত করে থাকে। পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য ফলদ বাগান নষ্ট করে দেওয়া এবং ট্রাক পুড়িয়ে দেয়াসহ শিক্ষা সফরে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বাস ডাকাতি-ইউপিডিএফের নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে।
ইত্তেফাক/কেআই